বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথি সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়িন ও তাবে-তাবেয়িন বিশ্বব্যাপী ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে প্রায়ই নানা রকেমের বৈঠক করতেন। তবে বিভিন্ন স্থানে বিশেষ কিছু বৈঠক বা সভা করতেন। এসব সভায় বিভিন্ন শাস্ত্রীয় জ্ঞান, নানা অবস্থা, বিশ্বপরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা হতো। জ্ঞান সভায় আলোচনা হতো কুরআন, সুন্নাহ, ফেকাহ-ফতোয়া, যুদ্ধ, সফর-সিয়ার-মাগাজি এবং আরব ইতিহাসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হতো মাজলিসুল আদব বা সাহিত্য আসর। তাদের এ সভাগুলো সর্বপ্রকার ফেতনা-ফাসাদ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। ছিল উন্মুক্ত ও দিলের খোরাক-দাওয়া। প্রতিটি বিষয়ে উন্মুক্ত ও প্রাণবন্ত আলোচনা হতো। নিম্নে ইসলামের প্রাথমিক যুগে মদিনার কতিপয় জ্ঞানসভার পরিচয় তুলে ধরা হলো-
সাহাবিদের সভা-বৈঠকগুলো বেশিরভাগ মসজিদে নববিতে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হতো। মদিনার বিভিন্ন গলি ও বস্তিতে হতো। বিশেষ করে ওয়াদিয়ে আকিকের পাড়া-মহল্লায় জ্ঞান ও সাহিত্য সভা একসঙ্গে কোনো কোনো দিন জমে থাকত। অংশ নিতেন সমকালীন জ্ঞানী-গুণী পণ্ডিত, বিতার্কিক, ভাষাবিদ, কবি সাহিত্যিকরা। আগ্রহভরে অংশ নিতেন নানা প্রান্তের জ্ঞানপিপাসু ও সাহিত্যনুরাগীরা। ঐতিহাসিক জুবায়ের বাক্কার লিখিত-‘নাওয়াদিরুল মাদিনিয়িন, কিতাবুল আকিক ও আখাবারিহা’, আবু আলি হারুন ইবনু জাকারিয়া লিখিত-‘কিতাবুল আকিক, কিতাবুন নাওয়াদির ও আত-তালিকাত’ আবুল ফরজ ইসপহানি লিখিত-‘কিতাবুল আগানি’, আবু আলি কারি লিখিত-‘কিতাবুল আমানি’ ইত্যাদি গ্রন্থে মদিনার জ্ঞান সভা ও সাহিত্য আসরের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও জ্ঞান-সাহিত্যের তিক্ষè বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। (কাজি আতহার মোবারকপুরি, খাইরুল করুন কি দরসগাহ : ৩৬৩-৬৫)
মজলিসুল কিলাদাহ
সাহাবা, তাবেয়িন ও তাবে-তাবেয়িন যুগে অসাধারণ কিছু জ্ঞানসভা ও সাহিত্য আসরের খবর পাওয়া যায় তম্মধ্যে একটি হলো ‘মজলিসুল কিলাদাহ’। এ মজলিসটি মসজিদে নববির ‘উস্তোয়ানায়ে উফুদ’ তথা রাসূল (সা.)-এর শয়নকক্ষের পার্শ্ববর্তী খুঁটিতে প্রতিরাত এশার নামাজ পর জমে উঠত। রাসূল (সা.)-এর দরবারে আরবের বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধি দল এলে রাসূল (সা.)-এর কামরার পার্শ্ববর্তী খুঁটির পাশে তাদের নিয়ে বসতেন বিধায় এটাকে ‘উস্তোয়ানায়ে উফুদ’ বলা হয়। এ সতুনের নিকটবর্তী দ্বিতীয় আরেকটি খুঁটির কাছে ‘মাজলিসুল কিলাদাহ’ অনুষ্ঠিত হতো। মদিনার সব ঐতিহাসিকরা এ মজলিসের শানমান বর্ণনা করেছেন। প্রাচীন ইতিহাসবিদ মুহাম্মাদ ইবনু জাবালাহ মাখজুমি মাদিনি (মৃত-১৯৯ হি.) তার ‘তারিখুল মদিনা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-মজলিসে কিলাদায় সমকালীন সব নামিদামি জ্ঞানী-গুণী অংশগ্রহণ করতেন। আল্লামা সামুদি লিখিত-‘ওফাউল ওফা’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, এটি মজলিসে কিলাদাহ নামে প্রসিদ্ধ। এখানে সাহাবি যুগের উলামা-ফুজালা এবং নানা জ্ঞানী-গুণী অংশগ্রহণ করতেন। (ওফা আল-ওফা, ১ম খণ্ড : ৪৪৯; খাইরুল করুন কি দরসগাহ : ৩৬৫)
মজলিসে উলামায়ে মাগাজি
তাবেয়ি ও তাবে-তাবেয়ি যুগে মদিনার বিজ্ঞ ওলামা-ফুকাহাদের জ্ঞান সভা ছাড়াও সিয়র-মাগাজি, যুদ্ধকালীন নানা কাহিনিবিষয়ক পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হতো। যে সভায় মাগাজি-সারায়া তথা যুদ্ধ-জিহাদ বিশেষজ্ঞরা ও যুদ্ধের বিবরণ লেখকরা অংশ নিতেন। এ বিষয়ের প্রসিদ্ধ লেখক আবু মাশর নজিহ ইবনু আব্দুর রহমান সিন্দি (মৃত : ১৭০ হিজরি) এসব সভায় নিয়মিত উপস্থিত হয়ে তাবেয়িন ওলামাদের কাছ থেকে যুদ্ধ বর্ণনাগুলো মুখস্থ করে নেন এবং পরে ইমামুল মাগাজি খেতাবপ্রাপ্ত হন। এ সময় মদিনায় ইলমুল মাগাজির গভীর জ্ঞানী এবং যুদ্ধ-জিহাদবিষয়ক লেখকদের বড় একটি দল ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন-উরওয়াহ ইবনু জুবায়ের (মৃত : ৯৪ হিজরি), আবান ইবনু উসমান ইবনু আফ্ফান (মৃত : ১০৫ হিজরি), আসিম ইবনু আমর ইবনু কাতাদাহ (মৃত : ১২০ হিজরি), শুরাহবিল ইবনু সাআদ (মৃত : ১২৩ হিজরি), মুহাম্মাদ ইবনু শিহাব জুহরি (মৃত : ১২৩ হিজরি), আবদুল্লাহ ইবনু আবু বকর ইবনু হাজম (মৃত : ১৩৫ হিজরি), ওলিদ ইবনু কাসির (মৃত : ১৫১ হিজরি), মুসা ইবনু উকবাহ (মৃত : ১৪১ হিজরি), আবদুল্লাহ ইবনু জাফর (মৃত : ১৭০ হিজরি), মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক (মৃত : ১৫১ হিজরি)। তারা পৃথক পৃথক মজলিসে মাগাজি করে পরস্পর আলোচনা-পর্যালোচনা করতেন এতে উপস্থিত শ্রোতারা উপকৃত হতেন। (তারিখে বাগদাদ, ১৩তম খণ্ড : ৪২৮; কিতাবুল মানাসিক, হরবি : ৩৬৬)।
সমকালীন সংলাপ
হজরত জায়নুল আবেদিন ইবনু আলি ইবনু হুসাইন, হজরত উরওয়াহ ইবনু জুবায়ের ও হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আলি (রা.)-এর মজলিস এশার নামাজের পর মসজিদে নববিতে অনুষ্ঠিত হতো। সমকালীন নানা বিষয়ে সংলাপ হতো। বিশেষ করে উমাইয়া খলিফা-উমারাদের রাজনীতি এবং শাসনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হতো। যেমনটা সাহাবি হাসান (রা.) পুত্রের বর্ণনায় উঠে এসেছে। তিনি বলেন-আলি ইবনু হুসাইন ও উরওয়াহ ইবনু জুবায়ের প্রতি রাত এশার নামাজের পর শেষ পর্যায়ে মসজিদে নববিতে বসতেন, আমিও তাদের সঙ্গে বসতাম। অতঃপর সমকালীন প্রেক্ষাপট, রাজনীতি, শাসনকার্য বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতো। (তাবাকাতে ইবনু সাআদ, ৫ম খণ্ড : ১৮১; তারিখে বাগদাদ, ১৩তম খণ্ড : ৪২৮)