ঠাকুরগাঁওয়ে বোরো রোপণে ব্যস্ত কৃষকরা, খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা

মোঃ আব্দুল জব্বার

খাদ্য শস্যর ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও। এই জেলার সব উপজেলায় চলতি মৌসুমে বোরো ধানের চারা রোপণ শুরু করেছে কৃষকরা। ফলে ব্যস্ত সময় পার করছে এখানকার কৃষকরা। বর্তমান সময়ে বিদ্যুৎ, সার, কীটনাশক, ডিজেল শ্রমিকসহ সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার বোরো চাষে অতিরিক্ত খরচের দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তাদের কপালে। মাঘের হিমেল বাতাস, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস আর ঘন কুয়াশাকে উপেক্ষা করে জমি তৈরি ও বোরো ধানের চারা রোপণ শুরু করেছেন ঠাকুরগাঁও জেলার চাষিরা। বোরো চারা রোপণে পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি ব্যস্ত সময় পার করছে নারী শ্রমিকরাও।

আবহাওয়া ভালো থাকলে বাম্পার ফলন ও ভালো দাম পেলে অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নিতে পারবে বলে আশা করছেন কৃষকরা।

অন্যদিকে উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৯’শত ৫০ হেক্টর জমি। গত বছরের লক্ষ্য মাত্রা ছিল ৯ হাজার ৮ শত ৫০ হেক্টরজমি।শুরু থেকে কৃষি অফিস থেকে সরকারি প্রণোদনাসহ সবধরনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে উপজেলা কৃষি অফিসের লোকজন।

১৮ ই ফেব্রুয়ারি রবিবার রানীশংকৈল উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়, বোরো ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। জমিতে বাড়তি সার হিসেবে বিঘা প্রতি ৬-৭ ভ্যান গোবর সার ছিটিয়ে দিচ্ছে। এরপর গভীর নলকূপ থেকে পানি দিয়ে জমি ভিজিয়ে নিয়ে পাওয়ার টিলার দিয়ে কেউবা মেসি (ট্রাক্টর) দিয়ে চাষ করা হচ্ছে। এতে বিঘা প্রতি ২০ কেজি ডেপ, ১২ কেজি পটাস, ৫ কেজি জিপসাম সার মিশিয়ে দ্বিতীয় বার চাষ করে চারা রোপণের জমি তৈরি করে জমিতে চারা রোপণ করছেন। ইতোমধ্যে এ উপজেলায় ১০-১৫ শতাংশ জমিতে চারা রোপণ শেষ হয়েছে।

উপজেলার সন্ধ্যারই গ্রামের গভীর নলকূপ এর মালিক হারুনুর রশিদ জানান, প্রতি বছর আমার এই গভীর নলকূপ দিয়ে এই মাঠে প্রায় ৩০০-৩৫০ বিঘা জমিতে পানি সেচ দিয়ে থাকি। এবারে ও ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ এর সংযোগ পেয়েছি এবং জমিতে পানি সেচ দিতে শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত এই গভীর নলকূপের আওতায় প্রায় ৬০-৭০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করেছে কৃষকরা। প্রতি ১০০ শতক (এক একর) জমির জন্য নেওয়া হচ্ছে ৪২০০ (চার হাজার দুই শত টাকা) টাকা। গত বছর নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮০০ টাকা। বিদ্যুৎ এর খরচ বেশি তাছাড়া সবকিছুর দাম বেশি কি আর করা।

উপজেলার মহল বাড়ি গ্রামের কৃষক জুয়েল রানা বলেন, আমি ১০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করি। প্রায় জমিতে চারা রোপণ হয়ে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ জমিতে চারা রোপণ শেষ হবে। তবে গত বছরের তুলনায় এবার খরচের হিসেব বেশি গুনতে হবে। পানি সেচের খরচ, জমি চাষ করা, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকসহ সবকিছুর দাম বেশি। তাই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে প্রণোদনা হিসেবে উফশী জাতের ধানের বীজ ও সার পেয়ে খুব উপকার হয়েছে। তবে এবার আবহাওয়া ভালো থাকলে গতবার মতো এবার ও বোরো ধানের ফলন ভালো হবে বলে আশা করছি। গত বছর ফসলের দাম ভালো পেয়েছি। আশা করছি এবারও ভালো দাম পাবো তাহলে খরচ পুষিয়ে নিতে পারবো বলে আশা করছি।

উপজেলার নয়ানপুর গ্রামের কৃষক জাকারিয়া বলেন, আমরা ছোট-খাটো কৃষক মানুষ, আমার বেশি আবাদি জমি নাই, ৫-৬ বিঘা জমি চাষ করি।মানুষ নিয়ে কাম করে নেই না, নিজেই সব করি। বছরে ইরি আর আমন ধান লাগাই তাতে আল্লাহ দিলে ভালোই আবাদ হয়, ভালোই চলে। এবারও লাগাছি আমরা, দেখু কি হয়? এবার তো সারের দাম, পানির দাম, কীটনাশক দাম আগের বছরের তুলনায় বেশি। ভালো ফলন আর ভাল দাম পেলে পুষে যাবে।

উপজেলার ৩ নং হোসেনগাঁও ইউনিয়নের বর্গা চাষি সুবহান বলেন, আমরা গরীব মানুষ নিজের আবাদি জমি নাই বললেই চলে। অন্যর জমি বর্গা নেই ইরি আবাদের জন্য, এক বিঘা জমি (৩৩ শতক) ১০ হাজার টাকা দিয়ে নিতে হয়েছে। বাজারে ইউরিয়া সার আগে ৮৫০-৯০০, পটাশ ৮০০, ডেপ ১০০০ টাকা ছিলো। বর্তমানে ইউরিয়া ১৩৫০, পটাশ ১১৫০, ডেপ ১০৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। জমি সেচের বাড়তি খরচ, সারের দাম, শ্রমিকদের মজুরি বেশি, সবকিছু মিলে কি হবে আল্লাহ ভালো জানে! তবে আশা করছি আবহাওয়া ভালো থাকলে এবং ধানের দাম ভালো পেলে খরচ পুষিয়ে নিতে পারবো ইনশাআল্লাহ!

উপজেলার নন্দুয়ার মাঠের জমি রোপণ করা শ্রমিক জামাল মিয়া বলেন, আমরা কয়েকজন মিলে একটা দল তৈরি করেছি। দীর্ঘদিন থেকে বোরো ও আমন ধানের চারা রোপণ করে থাকি। এবার বোরো ধানের চারা রোপণ প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) ১৩০০ টাকা করে নিচ্ছি। প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করতেছি। তবে এখন জমি গাড়ার অত চাপ নাই।

উপজেলার আরেক নারী শ্রমিক মালতী রানী বলেন, আমরা প্রতিদিন হাজিরা হিসেবে বোরো রোপণ করতেছি। প্রতিদিন হাজিরা হিসেবে ৫০০ টাকা পাচ্ছি।

রানীশংকৈল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সইদুল ইসলাম বলেন, চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৯’শ ৫০ হেক্টর জমি। ইতোমধ্যে চারা রোপণ শুরু হয়েছে। আশা করছি লক্ষ্য মাত্রার বেশি জমিতে বোরো চাষ হবে। ইতিমধ্যে উপজেলায় ১০-১৫ শতাংশ জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করা শেষ হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক উপজেলার প্রান্তিক কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বোরো হাইব্রিড ধানের বীজ (২৮০০) জন মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। আর উফশি জাতের প্রণোদনা হিসেবে (১৮০০) জনের মাঝে সার ও বীজ বিতরণ করেছি। বোরো চাষে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সব ধরনের পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও মাঠ কর্মীরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আশা করছি এবারও কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন কৃষকরা। এবারও ধানের দাম ভালো পেলে অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নিতে পারবে বলে আশা করছি আমরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *