দীর্ঘ নয় বছরধরে আক্কেলপুরে হোটেল মালিক রফিক বিনা পয়সায় ইফতার ও সেহরি করাচ্ছেন

নিরেন দাস,জয়পুরহাট প্রতিনিধি:-

জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে নয় বছর ধরে বিনা পয়সায় ইফতার এবং সেহরি করাচ্ছেন রফিক হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম। প্রতিদিন এক থেকে দেড়শো রোজাদার ব্যক্তি এখানে ইফতার এবং সেহরি করেন। বৃত্তবান ব্যক্তি না হলেও এগারো মাসে যা আয় করেন সেখান থেকে প্রতিদিন কিছু টাকা সঞ্চয় করে রমজান মাস জুড়ে তিনি ইফতার এবং সেহরি করান। রমজানের এক মাস মেহমানদারি করেন।

বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) ইফতার ও সেহরির সময় আক্কেলপুর কলেজ বাজার কাঁচা মালপট্টিতে রফিকের হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, ইফতার ও সেহরি খাওয়ার ভিড় চখে পড়ার মত। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল সবাই হাতে হাতে প্লেট নিয়ে যে যার মত করে টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন। তখন মালিকসহ বয়রাও ব্যস্ত সময় পার করছেন। খালি নেই কারও হাত। হোটেল জুড়ে চলছে জমজমাট সেহরিপর্ব। টাকা না দিয়ে সেহরি খাবেন সবাই, এটাই রোজার একমাস ধরে রফিক হোটেলের নিয়ম। এই নিয়মটি তিনি প্রায় নয় বছর থেকে ধরে রেখেছেন।

হোটেলটি তেমন একটা বড় নয়। মালিকও তেমন অবস্থাশালী নয়। তিনি বছরের এগারো মাস হোটেলের খাবার বিক্রি করেন। এই আয় দিয়ে তিনি পুরো বছর সংসার চালান। পাশাপাশি রমজান মাসে সাধারন মানুষকে টাকা ছাড়াই সেহরি ও ইফতার খাওয়ানোর জন্য টাকা জমা করতেন। প্রতিদিন সেহরিতে ১ শত ২০ এবং ইফতারে ১শ ৫০ রোজাদার ব্যাক্তিদের সেহরি ও ইফতারি করান।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হোটেল মালিকের নাম রফিকুল ইসলাম রফিক। তিনি ভাড়া নিয়ে হোটেল ব্যবসা করেন। আক্কেলপুর পৌরশহরের কেশবপুর গ্রামে তার বসবাস। তার হোটেলের নামও রফিক হোটেল। তিনি ২০১৬ সাল থেকে নয় বছর ধরে পৌর শহরে রফিক হোটেলে রমজান মাসে নিয়মিত টাকা ছাড়াই সেহরি ও ইফতার করাচ্ছেন রোজাদারকে। দূরদুরান্ত থেকে কলেজ হাটে আসা কৃষক, ট্রেন-বাস যাত্রী, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারী, হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজনরা এই হোটেলে টাকা ছাড়াই নিয়মিত সেহরি ও ইফতারি খাচ্ছেন। হোটেল মালিক রফিকুল নিজে এবং তার হোটেলের কর্মচারীররা মিলে ইফতারি ও সেহরির খাবার পরিবেশন করেন। সেহরির খাবারে ছিল গরুর মাংস, মাছ, ভাজি, ডাল এবং এক গ্লাস দুধ দিয়ে সমাপ্ত হয় সেহরি পর্ব। আর ইফতারিতে থাকে মাংসের বিরিয়ানী, ছোলা বুট, বুন্দা, মুড়ি, পিঁয়াজু, বেগুনি, সালাত সাথে একগ্লাস শরবত। রোজাদারেরা তৃপ্তি সহকারে সেহরি ও ইফতার করেন। হোটেলের অভ্যন্তর ছাড়িয়ে বাহিরে হাটের জায়গায় ডেকোরেটরের কাপড় বিছিয়ে ইফতার করানো হয়।

ইফতার খেতে আসা আক্কেলপুর পৌরসভার ইঞ্জিনিয়ার মোঃ রহিচ উদ্দীন মিয়া বলেন, চাকুরীর সুবাদে আমি এখানে একা থাকি। সারা বছর হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হয়। আর রমজান মাসে ইফতার ও সেহরি খাওয়া নিয়ে খুব চিন্তায় থাকতে হতো। রফিক আমাদের বিপদের বন্ধু। ইফতার খেয়ে টাকা দিতে চাইলেও সে কোন টাকা নেয় না। সকলকে ফ্রিতে ইফতার এবং সেহরি খাওয়ানোই তার ইচ্ছা। রফিক ভাই একটা দৃষ্টান্ত, এখান থেকে মানুষকে ও বৃত্তবানদের শিক্ষা নিতে হবে, সমাজে যারা অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষ তাদের পাশে দাড়ানো।

পার্শ্ববর্তী নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার কোলাহাট এলাকার বাসিন্দা রিফাত হোসেন শাওন বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী নিয়ে এসেছি। রাতে সেহরি খাওয়ার জন্য হোটেল খুঁজতে এসে এই হোটেলে আসি। এখানে অনেক ভালো মানের খাবার পরিবেশন করা হয়। খাবার পরে বিল দিতে এসে জানতে পারি তিনি টাকা না নিয়ে সেহরি খাওয়ান। তার এই কার্যক্রমে আমাদের মতো অনেক বিপদগ্রস্থ লোকের উপকার হয়।

কাঁচা সবজি ব্যাবসায়ী মোস্তাফার সাথে কথা হলে, তিনি বলেন, খুব সকালে কাঁচা মাল কিনতে বাজারে প্রতিদিন আসতে হয়। প্রতি রমজান মাসে পুরোমাস বিনা পয়সায় সেহরি ও ইফতার করান হোটেল মালিক। বিষয়টি আমার খুব ভাল লেগেছে। তাই আমিও মাল কিনতে এসে এখানে সেহরি খাই।

পৌর শহরের বিল্পব বলেন, এখানে এসে ইফতারের সময় হওয়ায় রফিক হোটেলে গিয়ে ইফতার করেছি। আমার কাছে ইফতারির টাকা নেয়নি। আমার মতো অনেকেই ইফতার করেছেন। রফিক যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা আনেক ভালো একটি কাজ। আল্লাহ পাক যেন তাকে রবকত দেন। তিনি যেন আরও বড় পরিশরে এমন সেবা দিতে পারেন।

ইফতার খেতে আসা কমলমতি শিশু বৃষ্টি বলেন, আমি এখানে ইফতার খেতে আসছি। ইফতারি খুব ভালো ছিল। ইফতারে বিরিয়ানী, খিরা-টমোটোর সালাতসহ আরও অনেক কিছু।

হোটেল মালিক রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, রমজান মাসে খাবারের হোটেলগুলো বন্ধ থাকে। এতে ইফতারি ও সেহরির সময় রোজাদারদের অনেক কষ্ট হয়। বছরের এগারো মাস আমি হোটেল ব্যবসার পাশাপাশি কিছু জিনিস যেমন চাল, ভুট্টা, আলুর চিপস্ স্টক করি। যা আয় হয় তার থেকে প্রতিদিন কিছু টাকা জমিয়ে রেখে রমজান মাসে সকল রোজাদারদের ইফতার ও সেহরি খাওয়ানোর চেষ্টা করি। ২০১৬ সাল থেকে এই কার্যক্রম শুরু করেছি। এ কাজে আমার হোটেলের কর্মচারীরা সহযোগীতা করে। তারাও এই মাসে কোন পারিশ্রমিক নেয় না। মূলত পরকালের মুক্তি এবং মহান আল্লাহর সন্তোষ্টির উদ্দেশ্যেই আমি এই কাজ করি। আমি যতদিন বাঁচবো এটা যেন চালু রাখতে পারি এজন্য আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা করবেন।

আক্কেলপুর পৌরসভার ৪নম্বর ওর্য়াড কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম পল্টু বলেন, জয়পুরহাট জেলার মধ্যে রফিক হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম তার হোটেলে নয় বছর ধরে টাকা ছাড়াই সেহরি ও ইফতার করিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমে বাহির এলাকা থেকে আগত রোজাদাররা অনেক উপকৃত হন। এটি একটি মহৎ কাজ। রফিক গরিব হলেও তার মন অনেক বড়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *